আবদুল জাববার খান : ২০০৬ সালে কক্সবাজারে একটা পাঁচ তারকা হোটেলে গেলাম ঈদের ছুটিতে।
উদ্দেশ্য রোজার ঈদ উদযাপন।
সাথে দুই কন্যা, স্ত্রী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও শালা বাবু। মোট সাত জনের একটা টিম।
তখন হঠাৎ করেই এই ট্রেন্ড চালু হয়েছে। ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে যাওয়া। আমার এসব ব্যাপারে কখনোই কোন আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু ফ্যামিলির চোখে ইজ্জত যায় যায় অবস্থা। কন্যারা মাকে বলে যে বাব্বা এতো কিছু করলো। স্মার্ট হতে পারলো না।
আগের দিন সকালের ফ্লাইটে পৌঁছে গেলাম। সবার মনে চরম উত্তেজনা। নিজেদের পরিবেশের বাইরে এই প্রথম ঈদ উদযাপন হতে যাচ্ছে। কাজেই কোন আনন্দ মিস করা যাবে না।
ঈদের সকালে কাছের মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করলাম। তারপর ফিরে এসে সবাইকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসেছি।
পাঁচ তারা হোটেলের বুফে আয়োজন। আইটেমের অভাব নেই। খেয়েদেয়ে সবাই সুইমিং পুলের সামনে, বিভিন্ন স্পটে নানারকম পোজে ছবি তুললাম।
তারপর আবার হোটেল সুইটে।
হঠাৎ করেই আমরা বুঝে ফেললাম যে ঈদ শেষ। আর কিছুই করার নেই। যাদেরকে গুরুত্বহীন মনে করে রেখে আসলাম, অর্থাৎ আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, ভাই বোন, বাবা মা, এরাই যে ঈদের স্পিরিট, তা বুঝে সবাই খুব বিমর্ষ হয়ে গেলাম। নেই কারও সঙ্গে আড্ডা, গল্প, বাচ্চাদের সালামি দেয়া নেয়া নিয়ে হৈচৈ, এবাড়ি ওবাড়ি দৌড়াদৌড়ি, কিছুই নেই।
মন কেঁদে উঠলো।
প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কখনো নিজেদের বৃত্তের বাইরে ঈদ করবো না।
২০০৮ সালে ইংল্যান্ড বেড়াতে যাবো। ভিসা পেতে দেরি হয়ে গেল। আবারও সেই রমজানে রওনা দিলাম। ফুল ফ্যামিলি অর্থাৎ চার জনে, ইত্তেহাদের ফ্লাইটে লন্ডন পৌঁছলাম ২০ রমজানে।
ওখানে আমার বন্ধু বান্ধব অনেক। সবাই সিলেটি। ছাত্র জীবনের বেশ অনেকটা সময় আমি সিলেটে কাটিয়েছি। তাই ফ্রেন্ডসার্কেল এভাবেই গড়ে উঠেছে।
ওরা যে সাপোর্ট এবং অভ্যর্থনা দিলো, কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল মন।
বন্ধু বান্ধব এবং ফ্যামিলি মিলে প্ল্যান করলাম, জমজমাট একটা ঈদ করবো এবার। সে অনুযায়ী একটা ছয় দরোজার বিশাল কার রেন্ট করা হলো। ঈদের দিন ওটা নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। এতো বড় গাড়িতে চড়ার অভিজ্ঞতা নেই। তাই সবাই উত্তেজনায় টইটম্বুর।
ঈদের পাঁচদিন আগে বাসে করে স্কটল্যান্ড বেড়াতে যাচ্ছি। দেখতে দেখতে যাওয়া। অত্যাধুনিক বাস। রাস্তা ঘাট এবং চারপাশের সৌন্দর্য দেখার মতো।
পথিমধ্যে একটা মল এলাকায় স্টপেজ দিলো। পৃথিবীর সব ব্র্যান্ডের ফার্স্টফুড শপ আছে ওখানে। একটা শপে ঢুকে আমরা কিছু খেয়ে কফি নিলাম।
আমার মন হঠাৎ কেঁদে উঠলো।
ভাবছি, এভাবে বিদেশ বিভূঁইয়ে ঈদ করার কোন মানে হয়? তারচেয়ে চলে যাই দেশে।
মনের চিন্তাটা স্ত্রী সুমিকে শেয়ার করলাম।
সেতো ক্ষেপলোই। বাচ্চাদের কেও ক্ষেপিয়ে দিলো। ওদের কথা হচ্ছে, আর মাত্র পাঁচদিন বাকি। আমরা স্কটল্যান্ড থেকে ফিরে ঈদ করবো। তারপর দেশে ফিরবো।
সুমি বললো,
: এই মূহুর্তে দেশে ফেরার টিকিট পাবে কোথায়? সব প্রবাসীরা এখন দেশে ফিরছে।
ফালতু চিন্তা বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিলো সে।
আমি নাছোড়বান্দা। সেলফোন থেকে ঢাকায় আমার বুকিং এজেন্টকে ফোন দিলাম। বললাম,
: তিনদিন পর রিটার্ন করতে চাই।
কথাটা শুনে এজেন্ট সাহেবের রীতিমতো হেঁচকি উঠে গেল। খুবই বিনয়ের সাথে বললো,
: ভাই, এটা তো অসম্ভব একটা চিন্তা ভাবনা। এই মূহুর্তে ঢাকা থেকে লন্ডন যাওয়া ইজি। কিন্তু রিটার্ন ফ্লাইট সব হাউজফুল। কোনভাবেই সম্ভব না।
বাসে বসেই এসব কথা হচ্ছে। আর আমার সঙ্গী সাথীরা উদ্বিগ্ন চেহারায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
আমি এজেন্টকে বললাম,
: আমি কোন কথাই শুনতে চাই না। পজিটিভলি কিছু একটা করুন!
উনি আমার কঠিন কন্ঠ টের পেয়ে বললেন,
: ঠিক আছে। আমি চেষ্টা করে দেখি।
রাতে স্কটল্যান্ডের হোটেলে পৌঁছেই রিটার্ন টিকিটের কনফারমেশন পেয়ে গেলাম।
ফ্লাইটের ডেট পড়েছে লন্ডনে ঈদের দিনে। আমরা ওখানে সেমাই খেয়ে রওনা দিলাম সকালের দিকটায়। দুপুরে ফ্লাইট। আবুধাবিতে পরেরদিন এসে ওদের ঈদ পেয়ে গেলাম। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে আমাদেরকে আবুধাবির ঐতিহ্য অনুযায়ী ঈদের খাবারে আপ্যায়ন করা হলো।
রাতে এসে ঢাকায় পৌঁছলাম।
হতাশা এবং ভ্রমণ ক্লান্তিতে বৌ বাচ্চাদের মুখ অন্ধকার।
পরের দিন ঈদ।
অসাধারণ একটা এক্সপেরিয়েন্স।
তিনটা দেশেই আমরা একইসাথে ঈদের ছোঁয়া পেয়ে গেলাম। নানা রঙের ঈদ।
কিন্তু মন খারাপ টা রয়েই গেল।
ওদের মন খারাপ, লন্ডনের জম্পেশ ঈদ আয়োজন মিস্ হয়ে গেল বলে। আমার মন খারাপ, ঈদ উপলক্ষে বাজার সদাই কিছুই ঘরে নেই। অবশ্য আগেই ফোনে কথা বলে রেখেছিলাম। আমার এক বোন তার বাসায় রান্নাবান্না করে সব ধরনের ঈদের খাবার পৌঁছে দিলো।
প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কখনও দেশের বাইরে ঈদ করবো না।
২০১২ সালে আবার।
এবার রমজানের ঈদ আমেরিকায়। বড় ভাইয়ের বাড়িতে। উনি আমার কাজিন।
কিন্তু খুব বেশি কাছের মানুষ।
এখানে অবশ্য প্রবাসে থেকেও, ভাই ভাবী এবং তাদের বাচ্চাদের সাথে হৈচৈ করে খুব মজা করে ঈদ পার করেছি। সালামি দেয়া নেয়ার মজাটা হয়েছে ডলারে। এটাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
আমার ছোট মেয়ে অরিন। সম্ভবত ক্লাস ওয়ান কিংবা টুতে পড়ে। দেখলাম, যাওয়ার আগেই ছোট একটা পার্স হাতে নিয়ে ঘুরছে। সবসময় ছোট ব্যাগটা হাতেই থাকে। ওটা নিয়েই ঘুমাতে যায়।
আমি বললাম,
: সবসময় এটা হাতে নিয়ে ঘুরছো কেন?
: বাব্বা, আমরা তো আমেরিকায় যাচ্ছি। এবার নিশ্চয়ই আমরা ডলারে সালামি কালেক্ট করবো। ওগুলো রাখার জন্য ব্যাগ লাগবে না ? বলে আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে। ওরা ডলারেই অনেক সালামি পেয়েছে।
তবুও আমার মন কেঁদে উঠেছে।
খুব কাছের মানুষগুলোকে খুব বেশি মিস্ করেছি। অবশ্য আমার এই হোমসিকনেসটা গোপন রাখতে সমর্থ হয়েছিলাম আমি।
আবারও প্রতিজ্ঞা করলাম, কাছের সব লোকজন ছাড়া আর কখনোই ঈদ করবো না।
কিন্তু আগের মতোই, এবারেও প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হলো। করোনা সিচুয়েশনে জন্মস্থান, বাসস্থান ঢাকা ছেড়ে ভালুকায় বসুধা রিসোর্টে ঈদ করতে হলো। দশ দিনের জন্য এসে আটকে গেছি। কাপড়চোপড়ও ঠিকমতো নিয়ে আসিনি। যদিও এটা নিজেরই বাড়ি। কিন্তু বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় – স্বজন কেউ নেই পাশে।
সেই পুরোনো হোমসিকনেসটা মাঝে মাঝেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মন কেঁদে উঠেছে বারবার।
শক্তভাবে নিজের মনকে দমন করেছি। কৃষিকাজ এবং লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চেষ্টা করেছি। সাত বছর আগে বানানো বাড়িটায় তেমনভাবে থাকাই হয়নি কখনও। এবারে লক ডাউনের কারণে বাধ্য হয়ে দুমাস ধরে আছি এখানে। বাড়িটা সহ পুরো রিসোর্টের নানারকম ভিডিও পোস্ট করেছি ফেসবুকে। সবাই অ্যাপ্রিশিয়েট করেছে।
এখানে সকালে ঘুম ভাঙ্গে হাজারো পাখির কিচিরমিচির শব্দে। কার সাধ্য আছে, এই ডাক উপেক্ষা করে, বিছানায় শুয়ে থাকবে ?
রাতে ঘুমোতে যাই, ঝিঁঝিঁ পোকা আর ব্যাঙের ডাক শুনতে শুনতে। সাথে যোগ হয়, রাতের খোলা বাতাসে গাছের পাতাগুলোর সড়সড় শব্দ। রাতে আমি একটু দেরি করে ঘুমোই। ঘুম তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করি এই নৈসর্গিক ভালোলাগা গুলো।
বাচ্চারা বারবার ঢাকায় ফেরার কথা বলছে। আমি তাদেরকে লক ডাউনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। বলেছি, এই ব্যবস্থাটা আমাদের নিরাপত্তার জন্যই করা হয়েছে। চলো, আমরা এটা না ভেঙ্গে, এখানেই ঈদের মজাটা নেয়ার চেষ্টা করি।
ফাইনালি, আমরা সাকসেসফুল।
সবচেয়ে কাছের উথুরা বাজারের দর্জি দোকান থেকে গজ কাপড়ের অর্ডার দিয়ে মেয়েরা জামা বানিয়েছে ঈদ উপলক্ষে। প্রথমে পরতে চায়নি। আমি আশ্বস্ত করে বলেছি, ফটোগ্রাফার বাবা আছে। কোন চিন্তা নেই। এমন ছবি তুলবো যে ইন্ডিয়ান ব্র্যান্ড মার খেয়ে যাবে। দেখবে, ফেসবুকে ছবি হিট। ওরা হেসে কুটিকুটি।
মাকে বলেছে, ঠিক আছে। অর্ডার দাও। এই কাপড়েই চলবে।
এখানে মিনাবাজার বা স্বপ্ন টাইপের ব্র্যান্ড শপ নেই। বাজারের মুদি দোকান থেকে কেনা সেমাই রান্না হয়েছে ঈদে। আমি বললাম, তেলে বা ঘিতে কড়া ভাজা দিয়ে চিনি ঢালো। ফাইনালি, সবই এক। খেয়ে দেখলাম, টেস্ট ভালো।
অনেক কিছুর অপ্রতুলতা থাকলেও, ঈদটা আমরা সবাই মিলে খুব এনজয় করেছি।
বদলে যাওয়া এক অচেনা ঈদ। সবুজ পরিবেশে সবুজ ঈদ।
এই প্রথমবারের মতো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বেঁচে থাকলে, সব ঈদই এখানে করার চেষ্টা করবো। করোনা বিহীন পৃথিবীতে, নিশ্চয়ই অনেকে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। গড়ে উঠবে নতুন ভূবন।
এই ভাবনায়, এই বাস্তবতায় এবার আর মনটা কেঁদে ওঠেনি। আলহামদুলিল্লাহ…!
লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বসুধা বিল্ডার্স লিঃ
আপনার মন্তব্য দিন