ফারজানা লায়লা জেনী : মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধাপ থাকে। প্রতিটি ধাপেই নানা অভিজ্ঞতার জন্ম হয়। আমারও জীবনের অনেক বাঁক – পরিবর্তন হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। একেক সময় একেক ধরনের বিপদ, বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হয়েছে নানাভাবে। আল্লাহতালার অশেষ কৃপায় কীভাবে যেনো উতরে যাই সবসময়।
২০২০ সালটা প্রথম থেকেই খুব খারাপ ছিলো আমার জন্য। বছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে বিশাল এক বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হলো। জানি না এ যাত্রায় উতরে যাবো কিনা ? জানি না এই বিপদের পর আর কোনো নতুন বিপদের জন্য বেঁচে থাকবো কিনা ? প্রতিদিন যুদ্ধ করছি সময়ের সঙ্গে। মনে হচ্ছে সময়টা পার হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। জানি না এই সময়টা পার করতে পারবো কি না ?
সবার কাছেই পরিবারের মূল্য নিজ নিজ অবস্থান থেকে অনেক। কিন্তু আমার কাছে পরিবার হলো নিজের জীবন, ভালোবাসা, সম্মান, ছাদ, ভরসা, আনন্দ, বন্ধন। আমি সম্পর্ককে খুব শ্রদ্ধা করি, সম্মান করি। আর সেটা যে কোনো সম্পর্কই হোক না কেন। আর এটা তো পরিবার। সবার উর্ধ্বে।
করোনার এই ক্রান্তিলগ্নে মিডিয়া, পত্র – পত্রিকায় নানারকম খবর দেখি। ছেলে বাবা – মাকে ফেলে দিয়ে গেছে। আবার বোন ভাইকে রেখে চলে গেছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা ব্যবস্থার বিপর্যয় হয়েছে। এই খবরগুলো শুনেছি, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। তবে নিজের অভিজ্ঞতা যখন হলো, তখন তা এতটা কষ্টদায়ক আর তিক্ত হবে – তা বুঝিনি।
ঈদের আগেরদিন আমার হাজব্যান্ড অসুস্থ হলো। দুইদিন দেখার পর তার অসুস্থতা যখন প্রকট আকার নিলো, আমি তখন তাকে নিয়ে একবার এই হাসপাতাল আরেকবার ওই হাসপাতালে ছুটছি। খাপছাড়া চিকিৎসা করে ছেড়ে দিচ্ছে। তারপর অনেক কষ্টে, অনেক অনুনয় বিনয় করে আনোয়ার খান মর্ডান হাসপাতালে এডমিট করালাম তাকে।
আর ওদিকে একমাত্র ছোটভাই জ্বরে ভুগছে। তার জন্য চিন্তা। এই সময়ের জ্বর মানেই তো প্রথমেই অন্য চিন্তা মাথায় আসে। মা আর সন্তানকে অন্য বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলাম। ছোটভাইয়ের কোভিড টেস্ট করাতে দিলাম। আর ওই দিন থেকেই চিকিৎসা শুরু করিয়ে দিলাম।
হাসপাতালে স্বামী আর বাসায় ভাই। একবার একে দেখি তারপর যাই বাসায়। ভাইকে খাবার, ওষুধ দিয়ে নিজেকে স্যানিটাইজ করি। বাসা তালা মেরে আবার আসি হাসপাতালে। কোথা থেকে এই শক্তি এসেছে আমি জানি না। নামাজ পরে আল্লাহর কাছে বলেছি – এ কোন ধরনের বিপদ দিলে তুমি আমায় ? একজন আমার জীবন আরেকজন আমার রক্ত। আমি কাকে ছেড়ে কাকে দেখবো ? কাকে একটু অবহেলা করবো ? এ কোন ধরনের উভয়সংকটে ফেললে আমায় প্রভু ?
এই দুঃসময়ে হাসপাতালগুলো এক রাক্ষসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আমি যখন হাজব্যান্ডকে এডমিট করিয়েছি, তখন কেবিন রেন্ট বললো ৭০০০ টাকার নীচে কোনো কেবিন তাদের এই মুহুর্তে নেই। আর বিল পে করার সময় দেখি কেবিন চার্জ ৯৫০০ টাকা। এমন কেন জিজ্ঞেস করায় একটা খোঁড়া যুক্তি দেখালো যে – আপনার ইমারজেন্সি ছিলো, কিন্তু পরে আমরা দেখি ৭০০০ টাকার কেবিন খালি নেই। তাই তাড়াহুড়ো করে এটাতে দিয়েছি।
অন্য সময় হলে আমি ঠিকই এই কারণ নিয়ে তর্কে যেতাম, ফাইট করতাম। আজ ইচ্ছে হলো না। মানসিক ভাবেও আমি ভালো নেই। প্রচন্ড ঘৃনা হলো এইসব বিবেকহীন মানুষগুলোর ওপর। রক্তচোষা নরপিশাচের দল। আর অন্যদিকে একই হাসপাতালে ছোট ভাইয়ের কোভিড টেস্ট করিয়েছি। খুবই আশ্চর্যজনকভাবে তা নেগেটিভ এসেছে। আরও অবাক হয়ে দেখলাম – আমার ডাক্তার বন্ধুরা বলেছিল, রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে কিন্তু তাও এটা পজেটিভ। তার মানে ব্যবসার নতুন পলিসি। নেগেটিভ আসার পর যেনো সবাই আবার টেস্ট করে। এই হলো দেশে সুচিকিতসা ব্যবস্থা। হায় সেলুকাস কী বিচিত্র এই দেশ!
আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে হাজব্যান্ডকে বাসায় নিয়ে এসেছি। কিন্তু ভাইটাকে তো খাইয়ে দিতে হয়, ইঞ্জেকশন দিয়ে দিতে হয়, অক্সিজেন দিয়ে দিতে হয়, স্যালাইন বদলিয়ে দিতে হয়। আর এসব করতে গিয়ে প্রতিদিন ৬/৭ বার গোসল করতে হচ্ছে। যতোটুকু সেইফ থেকে সব করা যায় করছি। বাকীটা আল্লহ মালিক, তিনিই জানেন। তবুও ভাই আমার সুস্থ হোক। আল্লাহর কাছে শুধু প্রার্থনা করছি আল্লাহ আমাকে সুস্থ রাখো, যেনো আমি ওদের দুজনের সেবা করতে পারি। আর আমি অসুস্থ হলে সব শেষ। আল্লাহ যেনো এমন বিপদ কাউকে না দেন।
এই ক্রান্তিলগ্নে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা আর দোয়ায় আমি সিক্ত। এত ফোন কল, এত ম্যাসেজ। সব আত্মীয় স্বজনরা, বন্ধুবান্ধব প্রতিনিয়ত খবর নিচ্ছে। দূরে যারা থাকেন ওনারা উদ্বিগ্ন। অনেক সময় অনেকের ফোন ধরতে পারছিনা, কথা বলতে পারছি না সেজন্য কেউ যেনো মনে কষ্ট না যেনো নেয়। সবাই আমার জন্য আর আমার পরিবারের জন্য দোয়া করো, আমি যেনো সুস্থ থাকি আর আমার দুই কান্ডারীকে যেনো ভালো করে তুলতে পারি। আমীন।
লেখক : কর্পোরেট চাকুরীজীবী ও কবি
আপনার মন্তব্য দিন