রেজাউল করিম শামীম : কেমন যেন একটি শিহরণ জাগানীয়া নাম ‘চাঁন রাত‘। এর সাথে সবারই নিশ্চই কোন না কোন ভাবে অল্মমধুর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। রোজার শেষে কখন চাঁদ,এক ফালি বাঁকা চাঁদ দেখা দেবে। তার অপেক্ষায় থেকেছি সেই ছোট বেলা থেকেই । এই চাঁদ আবার খুবই রহস্যময় যেনো। চাঁদ উঠলেইতো ঈদ। কিন্তু এটা কখন? ২৯ রোজার শেষে, না ত্রিশ রোজার শেষে? অবশ্য ৩০ রোজা হলে সেদিন চাঁদ যে উঠবেই ,তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। চাঁদ উঠুক আর না উঠুক,দেখা যাক আর নাই যাক পরদিন অবশ্যই ঈদ। আর এই ২৯ এবং ৩০ রোজার শেষ কে নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির যেন শেষ নেই। গেলো বছরও কিন্তু এমনি একটি ঝামেলায় পরতে হয়েছিলো। ২৯ রোজা শেষে চাঁদ নিয়ে কোন খবর নেই। ফলে যে যার মতো করে ৩০ রোজার জন্য প্রস্ততি নিয়েছেন। এমন কি তারাবির নামাজও যথারিতি আদায় করা হয়ে গেছে ।এরপর রাতে ইলেক্ট্রনিক খবর মাধম্যে ধর্ম মন্ত্রনালয় থেকে ঘোষনা এলো, পরদিন ঈদ। আর যায় কোথায়। পরিমরি করে সকলে ছুটলেন বাজারে। ঈদের বাজার করতে। কারন, ঈদের দিনতো রোজা রাখা হারাম। ফলে ঈদ করতেই হবে।
মজার ব্যপার হলো,৩০ রোজা শেষে ঈদ হলে রেডিমেইড দোকান-পাটের মালিক পক্ষ বেজায় খুশি। তারা বেচাবিক্রির আর একটি দিন যেন বাড়তি পেলো। বাড়তি বিক্রি-সেই খুশি যেন আর ধরেনা। এমনিতেই ব্যবসায়ীদের জন্যে রোজার মাসটি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ন হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। সারা বছর ধরে এ মাসটির জন্যে তারা অপেক্ষ করে থাকেন। বছর ধরে তারা নতুন নতুন ডিজাইন, বাছাই করা কাপড়, রঙ মেলানো বাহারি সব পোষাক পরিচ্ছদ তৈরী করেন। আমদানী করে মওজুদও করেন। দেশের বিভিন্ন স্থানের ব্যবসায়ীরা আগাম অর্থ দিয়ে রাখেন পাইকারী আর প্রস্তুতকারীদের কাছে। রোজার শুরুতে সেগুলো যার যার দোকানে তুলে বিক্রির অপেক্ষায় থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব মালামাল খুচরো ব্যবসায়ীদের কাছে বাকিতেই দেয়া হয়। বেচা–বিক্রির হিসাবপত্র সব শেষ হয় রোজার শেষে। সেই চাঁদ রাতে।অথ্যৎ যেদিন চাঁদ উঠবে,সেই রাতে। এই এতটুকু কথার মধ্যে কিন্তু দেশের বিশার একটি অর্থনৈতিক কর্মকান্ড জড়িত। পরিমানটি প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা।
এই চাঁদ রাত কিন্তু আমার জন্যে অন্যরকম একটি অনুভব,উপলদ্বি। জীবনভর বহে বেড়ানোর মতো স্মৃতি।এ কটা সময় ছিলো,আমার সাংবাদিকতা, রাজনীতিসহ সামাজিক সব কর্মর্কান্ড চলেছে প্রিয় কুমিল্লাকে ঘিরে। কুমিল্লায় অবস্থান করেই কেটেছে সেই সব দিনরাত্রি।পরবর্তীতে যখন ঢাকায় চলে এলাম, তখনো কুমিল্লার সাথেই সংযুক্ত থাকার চেষ্টায়, সামান্য ছুটিছাটায়ও কুমিল্লায় কেটেছে সময়। তখন কুমিল্লা যাওয়া-আসা খুবই সহজ ছিলো। কিন্তু পরে অনেক ঝুটঝামেলা আর সময়ের টানাপড়েনে আনন্দে পরে ছেদ্।
বলছিলাম চাঁদ রাতের কথা। দু‘দিন আগে থেকেই সেযে কি আনন্দময় পরিবেশ। গোটা শহরময় যেন একটা মহোৎসব। দোকানে দোকানে বর্ণীল অলোঝলমল করা বৈদ্যুতিক বাতির ফোয়ারা। সকলকেই দেখায় রঙ্গিন,ঝকঝকে। লোকজনের চলাফেরায় নানা ব্যাস্ততা। বন্ধে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে চাকুরিজীদের নিজ বাসভূমে ফিরে আসা। সন্ধ্যার পরই শহরের বিভিন্ন স্থানে পরিচিতজনের সাথে দেখা, মেলামেশার আনন্দ যেন উছলে পড়ে। ফি বছরই এমটি দেখে এসেছি।
আমরা বসতাম মনোহরপুরের বড় কাপড়ের দোকাক‘খাদি ভবনে‘। প্রথম দিকে দোকানে বসতেন মালিকের বড় ছেলে আমাদের প্রিয় বিজয়‘দা। পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পরায়, সেখানে আসে ওনার ছোট ভাই সানাই। এই ভবনেরই একটু সামনে, রাস্তার ওপাড়ে ছিলো অপর একটি ঐতিহ্যবাহী খদ্দরের বিপনী‘খাদি ঘর‘। আরো ছিলো জাকিরের আবরণী, প্রদীপের বিশুদ্ধ খদ্দর ভান্ডার। এসব বড় বড় দোকানে আমাদের আড্ডা ছিল নির্ধারিত। তবে খাদি ভবনেই বেশি। এছাড়া গোটা শহর জুড়েই এমনি অসংখ্য দোকান ঘিরেই ছিলো ক্রেতা সাধারনের ভীড় আর বেচাকেনার ধুম।
খুব ভালো লাগতো, সেসময় পরিচিতদের আড্ডা। তখনকার সময়ের সাংবাদিক,গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, অধ্যাপক আলী হোসেন চৌধুরী, নুরুর রহমান বাবুল, নাছির উদ্দিনতো ছিলোই। তাছাড়া, টিটু ভূইয়া,আলাউদ্দিন তালুকদার কখনো আবার অধ্যাপক আনোয়ারুল হক, শওকত আহসান ফারুক,ফখরুল ইসলাম রচি, স্কুইব ফার্মাসিটিউকলের জেলা ম্যনেজার অমলেশ‘দা,অধ্যাপক খইরুল হোসাইন মনু এসে যোগ দিত। ক্রেতা সাধারনে আসা-যাওয়া, তাদের বিভিন্ন ভাবে সাঁজানো পাঞ্জাবি,সার্ট, শাড়ি, জামাকাপড় ইত্যাদি দেখা। পছন্দ নিয়ে নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে কাথাকাটাকাটি, প্রাপ্তির আনন্দ। আবার পছন্দ আর মূ্ল্যের মিল না হওয়ায়,না পাওয়ার বিরক্তি এবং কষ্ট- এগুলো দেখতাম। উপভোগ করতাম। নিজেদের মধ্যে আবার এসব নিয়ে আলোচনা হতো। বাড়তি পাওয়া ছিলো শহরের বিভিন্ন স্থানের রমনীদের দেখা মুখগুলোকে খুব কাছে থেকে দেখা। কত চেনা মনে হয় কিন্তু অচেনা অথ্যাৎ কখনো আলাপ হয়নি। আমরাও তখন যেচে, সেলসম্যন হয়ে যেতাম, ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কথা বলে গছিয়ে দিতাম ‘খাদি ভবনে‘ এর ব্যগে কাপড়। সুবিধে ছিলো সেখানে দামাদামির কোন ঝামেলা ছিলোনা। ফিক্সড রেইটের আইটেম। পছন্দ হলেই হতো। ব্যাগ হাতে টাকা কমে। এমনি ভাবে দেখাশোনায় ব্যাস্ততায় ক্রেতাদের বিশেষ করে সেঁজেগুজে পরিপাটি হয়ে আসা রমনীদের কাপড় স্থানচ্যুত হতোই। শাড়ির আঁচল,ওড়না এগুলো সঠিক স্থানে না থাকায় উঁকিঝঁকি দেয়ার বয়স ছিলো। পরে এসব নিয়ে মুখরোচক নানা আলোচনা। এ ক্ষেত্রে শওকত ছিলো সরস।
অনেক রাত পর্যন্ত চলতো বেচাকেনা আর আমাদের আড্ডা। এর মাঝে চা-নাস্তার পর্বতো ছিলোই। পাশেই ছিলো‘ মিষ্টি মুখ‘ নামের মিষ্টির দোকান। সেখানকার লবঙ্গ,আর লুচি-সিঙ্গারা ছিলো বিখ্যাত। আমাদের খাবারের শেষ আইটেম ছিলো আগে থেকে ওয়ার্ডার দেয় তেহারি বা বিরিয়ানি। কিযে স্বাদ! এখনো যেন মুখে লেগে আছে। এসবের মাঝেই আগে থেকে হিসেব করে রাখা পাওনাদারদের হাতে টাকা তুলে দেয়া। ঢাকা, চান্দিনা, বাবুর হাট, মারচন্দ্রপুর, মুন্সিগঞ্জ এমনকি টাঙ্গাইল, নরসিংদি থেকে কাপড়ের মহাজনদের কাছ থেকে বাকিতে আনা বিভিন্ন কাপড়ের মূল্য পরিশোধ করা। মালিক কিংবা তাদের প্রেরিত প্রতিনিধিরা এই দিনটির জন্যে অপেক্ষা করে থাকেন। সারা মাস বেচাবিক্রি করে সানাইরা এসব টাকার হিসাব বুঝিয়ে দেয় চাঁদ রাতে।
কিন্তু হায়, এবার আর চাঁদ রাতের নেই সেই যৌলুশ। করোনা এসে সব লন্ডভন্ড করে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মে মাসের ১০ তারিখের পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দোকানপাট, বিপনী বিতান, হাটবাজার সরকারি নির্দেশে স্বাস্থ্য বিধি মেনে খোলা হলেও, কুমিল্লা তার ব্যতিক্রম। সেখানকার দোকান মালিক সমিতির সিন্ধান্তে মহানগরের সব দোকানপাট বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। ঈদ পর্যন্ত এ অবস্থা থাকবে বলে জানানো হয়েছে। ফলে সানাই, কান্তি‘দা সহ সেখানকার সব দোকানপাট বন্ধ। রাস্তায় সুনসান নিরবতা। এর আগে সেখাকার ঐতিহ্যবাহী রাজগঞ্জ বাজার ও তৎসংলগ্ন রাজবাড়ি কম্পাউন্ডে করোনা রোগী পাওয়া যাওয়ায়, সে এলাকা লকডাউন করা হয়েছে। ফলে বাজারে অনেকেই, এখন ফাঁকা পেয়ে বন্ধ দোকানগুলোর সামনে বসেছে শাকসব্জি,কছুঘেটু নিয়ে। সানাইয়ের পাঠানো খাদিভবন, খাদিঘর এলাকার রাস্তার ছবিতে দেখা যায় সেইসব দৃশ্য।
কিন্তু চাঁদ রাতকে সামনে রেখে এমন ছবিই কি দেখার ছিলো? কুমিল্লা মহানগর এলাকায় দোকান রয়েছে ১৩ হাজারের উপর। আর কর্মচারি ৮০ হাজারেরও বেশি। এ তথ্য কুমিল্লা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আতিকুল্লাহ খোকনের। তার সাথে ফোনে আলাপকালে জানতে চেয়েছিলাম এই হাজার হাজার অসহায় কর্মচারি যারা ঈদকে সামনে রেখে আশায় থাকে বেতন-বোনাস পাওয়ার জন্যে, তাদের এখন কি উপায়।? কি অবস্থা মালিক আর তাদের লগ্নিকৃত কোটি কোটি টাকার? সে জানায়, শত দুরাবস্থার মাঝেও তারা, মালিকরা কিছু কিছু বেতন দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরপর কি হবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
এদিকে, ‘কুমিল্লার কাগজ‘এর সম্পাদক ও চ্যনেল আইয়ের প্রতিনিধি আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন আবুল কাশেম হৃদয়ের সাথে কথা হলো ফোনে। সে জানালো কুমিল্লায় আক্রান্তে সংখ্য ৩৪। তবে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। বিশেষ করে শহরে। টেষ্ট কম হয় বলে এই সীমিত সংখ্যা দৃশ্যমান হচ্ছে। অপর দিকে দৈনিক ‘আমাদের কুমিল্লা“ এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আমার প্রিয় অনুজ, সাংবাদিক শাহজাদা এমরান তাদের প্রকাশনা অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে বল্লো, কুমিল্লার অবস্থা খুব ভালো না।
ভালোনা আমাদের কুমিল্লা বাসার অবস্থাও। ঝাউতলায় আমাদের বাসার ঠিক উল্টো দিকে রাস্তার ওপাড়ে সিভিক স্কোয়ারের ১১তলার এক বাসিন্দার করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে। ঐ ব্যক্তি সদর হাসপাতারে কাজ করতো। সে টেষ্ট করাতে দিয়ে এসেও দিব্যি ঘোরাঘুরি করতো। আমাদের এলাকার কাউন্সিলার মন্জুর কাদের মনি জানিয়েছে বিল্ডিংটি লকডাইন করা হচ্ছে। এ নিয়ে বাসার সকলের উদ্বেগ, উৎকন্ঠা বেড়ে গেছে। দুশ্চিন্তা, কুমিল্লার বাসায় আমার একমাত্র বড় ভাই,বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউর রহমান বুলবুল আর সবচাইতে কনিষ্ট সদস্য আমাদের নাতনী রোজাকে নিয়ে। বুলবুল ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে রাতুল, তার একমাত্র সন্তান রোজাকে নিয়ে ঢাকা থেকে কুমিল্লা গিয়েছিলো বাবাকে দেখতে। এরপর আটকা পড়েছে সেখানে। অন্যদিকে ঢাকায় আমার ঘনিষ্ট এক আত্নীয়,পেশায় সে ডাক্তার। গতকালই খবর পেলাম সেও আক্রান্ত।
এমনি দূর্ভোগের মধ্যে কিসের চাঁদ রাত আর কিসেরই বা ঈদ? কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে আজ শুধুই হাহাকার। অনেকেই অনেক কষ্ট করে বাড়িতে ছুটে গেছেন। একই অবস্থায় ফিরে আসবেন তারা। এরা একবার গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে আসবেন, আবার অনেকে সেখান থেকে বহন করে নিয়ে আসবেন করোনা। তখন কি অবস্থা দাঁড়াবে -তা চিন্তা করা যায়? যাক কি আর করার আছে! হায় হুতাশ আর নয়। এর মধ্যেই সকলকে ভালো থাকতে হবে। নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে আর সকলকে সকলের জন্যে দোয়া করতে হবে। শুভকামনা জানাতে হবে সবাই ভালো থাকুন। বেঁচে থাকলে আবারো চাঁদ রাত হবে। ঈদ বয়ে নিয়ে আসবে অনাবিল আনন্দ। আবার জমবে মেলা, বটতলা হাটখোলা,পৃথিবী অবাক চেয়ে রবে, সোনার বাংলা ভরবে সোনায়…
আপনার মন্তব্য দিন