শপথ চৌধুরী : সৌন্দর্য্য ও কণ্ঠশৈলীর সৌকর্যে খুব অল্প সময়েই সুরলোকে যিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন তার নাম কর্ণিয়া। পুরো নাম জাকিয়া সুলতানা কর্ণিয়া। ২০১২ সালে চ্যানেল নাইন’র রিয়্যালিটি শো’ ‘পাওয়ার ভয়েস’ এ প্রথম রানার আপ হওয়ার মাধ্যমেই শ্রোতা-দর্শকদের কাছে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। এরপর শুধুই এগিয়ে যাওয়ার পালা। হাল সময়ে সংগীতের টিনেজ সেনসেশন তিনি। কি গায়কীতে, কি সৌন্দর্য্যে! রীতিমত তরুণদের হার্টথ্রব।
পাওয়ার ভয়েস’র মাধ্যমে কর্ণিয়ার পরিচিতি আসলেও সঙ্গীতের সঙ্গে তার সখ্যতা ছোটবেলা থেকেই। মা সেলিনা আক্তারের কাছেই তার প্রথম সংগীতের অ-আ-ক-খ শেখা। এরপর সংগীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন ছায়ানট থেকে। সে হিসেবে ক্লাসিক্যাল ও নজরুল সংগীতের ওপর তার বেশ ভালো দখল রয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি আধুনিক গানের প্রতি দুর্বলতা ছিল তার। এরই রেশ ধরে তৈরি হয়েছে আজকের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কর্ণিয়ার। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক জনপ্রিয় শিল্পী রয়েছেন যাদের ক্লাসিক্যাল সম্পর্কে ধারণা কম। কিন্তু এক্ষেত্রে কর্ণিয়া তাদের চেয়ে যোজন যোজন মাইল এগিয়ে। শুধু কণ্ঠই নয়, সাথে রয়েছে তার সৌন্দর্য্য ও পারফরমেন্স। মঞ্চেতো তিনি একেবারে মারমুখি। ভিন্ন স্টাইলে গাওয়ার পাশাপাশি তার একসেসরিজ, পারফরমেন্স সবকিছুতেই রয়েছে পশ্চিমাস্য ছোঁয়া। যে কারণে কর্ণিয়ার আগের জেনারেশনের অনেক জনপ্রিয় শিল্পীই মঞ্চে তাকে এড়িয়ে চলেন। আসলে টিন সেনসেশন কর্ণিয়া অনেকটা ব্রিটনি স্পিয়ার্স কিংবা আভ্রিণ লাভিনদের মতো। সবকিছু ভেঙ্গেচুরে দেওয়াই যেন উদ্দেশ্য।
পাওয়ার ভয়েস এ অংশগ্রহণের পূর্ব থেকেই কর্ণিয়া মঞ্চে নিয়মিত পারফর্ম করতেন। অর্থাৎ নিষ্পাপ বয়োঃসন্ধির সুবর্ণ সময়েই সংগীতে প্রফেশনাল জার্নি শুরু হয় তার। ইদানীং ফিমেল সিঙ্গারদের মধ্যে রক প্যাটার্নের গান করেন এমন সংখ্যা খুবই কম। এখানেই কর্ণিয়া অন্য অনেক ফিমেল সিঙ্গারদের চাইতে আলাদা। গতানুগতিক পথে পা না বাড়িয়ে একটু ভিন্ন পথে এগিয়েছেন তিনি, মাতোয়ারা করেছেন সঙ্গীতাঙ্গন।
সাম্প্রতিক ব্যস্ততা নিয়ে কর্ণিয়া জানান, ‘স্টেজ শো নিয়েই আমাকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। স্টেজে সময় দিতে গিয়ে বাকী কাজগুলো অনেক সময় ঠিকমত করা হয়ে ওঠে না। তবুও মাঝে মাঝে অডিওতে সিঙ্গেলস এর কাজগুলো করছি। কিছুদিন আগেই করলাম স্টুডিও ডকইয়ার্ড’ থেকে একটি গান ‘লাগ ভেলকি’ শিরোনামে। এ গানটির ভিডিও ডিরেকশন দিয়েছেন ফরহাদ আহমেদ। এছাড়া ডিজে রাহাতের একটি প্রজেক্ট ‘গ্যারেজ’-এ কাভার সঙ ‘কলংকিনী রাধা’ ও করেছি সম্প্রতি। এ গানটির ভিডিও নির্মাণ করেছেন তানভীর খান।
পাওয়ার ভয়েস এ থাকাকালীনই ২০১৩ সালে প্রথম প্লেব্যাক করেন কর্ণিয়া। তখন ‘রাঙামন’ ছবিতে পাওয়ার ভয়েসের অপর শিল্পী রাজুর সঙ্গে তিনি গানটি করেন। এরপর ‘দ্য স্টোরি অফ সামারা’ ছবিতে একটি সলো গান, তন্ময় তানসেনের ‘রানআউট’ ছবিতে রূপমের সঙ্গে ডুয়েট একটি গান এবং পুড়ে যায় মন ছবিতে ‘ওরে প্রিয়া’ শিরোনামের একটি গান করেন। সর্বশেষ রেজওয়ান শেখ’র সংগীত পরিচালনায় ‘ধকর’ ছবিতে ইবরার টিপুর সঙ্গে একটি ডুয়েট গান করেন। প্লেব্যাকের প্রতি নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করে কর্ণিয়া বলেন, ‘এ মাধ্যমে কাজ করার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে আমার। কিন্তু স্টেজ’র ব্যস্ততার কারণে অনেক কাজ ফিরিয়ে দিয়েছি। তা না হলে প্লেব্যাকে আরো অনেক বেশী কাজ করার অফার ছিল। তবে আগামীতে স্টেজ শো করার পাশাপাশি প্লেব্যাকের জন্যও সময় বের করে নেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে।’
ভার্সেটাইল গায়িকা কর্ণিয়ার প্রথম সিঙ্গেলসটি ছিল ২০১৫ সালে আরফিন রুমি’র করা ‘হিরো’ শিরোনামে। এরপর সেতু চৌধুরীর সঙ্গীতায়োজনে এবং তানভীর খানের ভিডিও নির্দেশনায় ‘গাঙচিল’ ও ‘তোমায়’ শিরোনামে দু’টি গান করেন। ‘তুই সে ভালো থাক’ শিরোনামের একটি গান করেন শাহরিদ বেলালের লিরিক ও টিউন এ। তবে মেহেদী হাসান লিমনের কথা ও নাজির মাহমুদের সুরে আসিফের সঙ্গে ডুয়েট ‘কি করে তোকে বোঝাই’ শিরোনামের গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় বলে কর্ণিয়া জানান। এ গানের সফলতার পিছনে আসিফের জনপ্রিয়তা নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে কর্নিয়া জানান, ‘আমি সেরকম ভাবি না, অবশ্যই আসিফ ভাইয়ের জনপ্রিয়তা এখানে কাজ করেছে। তবে পুরোপুরি, সেটা আমি মানতে নারাজ। বরং এভাবে বললে সুন্দর হবে যে, আমার আর আসিফ ভাইয়ের রসায়নটা শ্রোতা-দর্শক ভালোভাবে গ্রহণ করেছে। কেননা, আমার আগেও অনেক ফিমেল সিঙ্গারের সঙ্গে আসিফ ভাই গান করেছেন। সেগুলোর সবগুলোই কি হিট করেছে? তাই আমি বলবো, শুধু আসিফ ভাইয়ের কারণেই নয় আমার গ্রহণযোগ্যতাও এখানে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই।’
পাওয়ার ভয়েস আপনাকে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠা পাবার জন্য এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম কি খুব জরুরি?
এমন প্রশ্নের উত্তরে কর্ণিয়া জানান, ‘প্ল্যাটফর্ম থাকলে ভালো, কিন্তু সেটা না থাকলে যে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যাবে না বিষয়টি এমন না। তবে বর্তমানে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে একটি প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, আমি অনেক আগ থেকেই কমার্শিয়াল শো করি কিন্তু আমাকে তেমনভাবে কেউ চিনতো না। কিন্তু পাওয়ার ভয়েসে যাওয়ার পরপরই রাতারাতি আমার পরিচিতি বেড়ে যায়, পাশাপাশি গ্রহণযোগ্যতাও।’
প্ল্যাটফর্ম ছাড়া পরিচিতি লাভ কিংবা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রে কি কি প্রতিবন্ধকতা ফেস করতে হয় বলে আপনার মনে হয়?
মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি বড় হওয়ার পাশাপাশি এখানে অনেক প্রতিবন্ধকতাও তৈরি হয়েছে। আগে যেমন একটি গানই একজন শিল্পীর জনপ্রিয়তা তৈরি করে দিত, এখন তা অনেকটাই অসম্ভব। কারণ কে যে কোথায় কি গান করছে তার হিসেব নেই। শ্রোতা-দর্শকদের চোখে পড়া এখন খুবই দুরূহ কাজ। আগে যেমন অ্যালবামের যুগ ছিল। একজন শিল্পীর মূল্যায়ন বা জনপ্রিয়তা তৈরি হতো অ্যালবামের বদৌলতে। এখন সেটা নাই। সিঙ্গেলস’র যুগে ভালো ফোকাস ছাড়া শ্রোতা-দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ অনেক কঠিন। পাশাপাশি এতো এতো টিভি চ্যানেলের ভিড়ে অনেক গান করেও পরিচিতি পাওয়া দুষ্কর। তাই নির্দিষ্ট একটা প্লাটফর্মের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে পারলে সুবিধাই বেশি।
আপনিতো স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত। সেক্ষেত্রে এর পরিধি কি শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি বিদেশেও শো করছেন?
বিদেশে এখনও শো করা হয়ে ওঠেনি। অফার এসেছে অনেক কিন্তু কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে যেতে পারছি না।
যেমন?
বাইরে শো’র ক্ষেত্রে আমার প্রধান শর্ত হলো অভিভাবক ছাড়া যাওয়া অসম্ভব। তারপর রয়েছে নিজস্ব মিউজিশিয়ানের বিষয়। এই শর্তগুলো পূরণ হয়নি বলেই যাওয়া হয়নি।
অনেকেইতো এসব ছাড়াই শো করে যাচ্ছেন?
তা যাচ্ছেন। আমার চাইতে অনেক বড় শিল্পীও যাচ্ছেন। কিন্তু আমার নিজের সন্তুষ্টির জন্য আমি আমার মতো করেই যেতে চাই।
মূলতঃ পপ, সফট মেলোডি এবং রক প্যাটার্নের গান করেন কর্ণিয়া। এতোক্ষণ তার সম্পর্কে অনেক টীকা দেওয়া হলো। একটু টিপ্পনিরও প্রয়োজন রয়েছে বৈকি; যদি তার প্রফেশনাল ক্যারিয়ার পাওয়ার ভয়েস থেকে ধরা হয় তাহলে এখন চলছে ক্যারিয়ারের অর্ধযুগ। একেবারে কম সময় নয়। এই সময়ের মধ্যে তার জনপ্রিয় গান কোনটি? মঞ্চে কি এখনও তিনি অন্য শিল্পীর জনপ্রিয় গানগুলো কাভার করেন?
এমন প্রশ্নের উত্তরে কর্ণিয়া কোন প্রকার ইতস্তত না করেই বলেন, ‘গান জনপ্রিয় হওয়া এখন অত্যন্ত কঠিন বিষয়। আসিফ ভাইয়ের সঙ্গে গাওয়া গানটি ছাড়া আমার অন্যান্য গানগুলো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। এ নিয়ে আমার নিজের মধ্যেও অনেক অতৃপ্তি রয়েছে। কারণ আমি জনপ্রিয় কিন্তু আমার গান জনপ্রিয় নয়। যে কারণে মঞ্চে অন্যের গান কাভার করতে হয় আমাকে। অথচ নিজের গান গাওয়ার যে কি শান্তি তা বোঝানো যাবে না। কিন্তু ভালো গান করার জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। অনেকেই হয়তো আহত হবেন আমার কথায় যে, আমাদের দেশে ভালো সংগীত পরিচালকের বড় অভাব। বিশেষ করে বর্তমানে আমরা যে ধরনের গান করতে চাই সে ধরনের মিউজিক করার মতো কম্পোজার খুবই কম। আমি বলতে চাচ্ছি সংখ্যা বিবেচনায়। যারা আছেন তারা অত্যন্ত ব্যস্ত। শিডিউল পাওয়া মুশকিল। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো গান করা এখন এতো এক্সপেনসিভ হয়ে গেছে যে, কুলিয়ে ওঠা মুশকিল। তবুও ইচ্ছে আছে আগামীতে ভালো কিছু গান শ্রোতা-দর্শকদের উপহার দেওয়ার।
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ পাস করা কর্নিয়ার মধ্যে নিজের ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়ে অসম্ভব দৃঢ়তা লক্ষ্য করা যায়। কারণ ছোটবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছেন। কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। দু’বোন ও মাকে নিয়ে গোছানো সংসার তাদের। ছোট বোন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ডেন্টালে পড়ছেন। বাবাহীন সংসারে মা-ই তাদের সকল আশ্রয়স্থল, চালিকাশক্তি। গান গাওয়ার পাশাপাশি কর্ণিয়ার ইচ্ছে এমবিএ কমপ্লিট করা।
পরিশেষে বলা যায়, দেশীয় সংগীত দুনিয়ায় গত কয়েক বছর ধরে মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন যারা তাদের মধ্যে কর্ণিয়া নিঃসন্দেহে অন্যতম। আর শ্রোতা-দর্শককে মাতোয়ারা করে দেবার জন্য একজন শিল্পীর যে গুণগুলো থাকা দরকার তার সবই রয়েছে কর্ণিয়ার মধ্যে। চোখ ধাঁধানো গ্ল্যামার, সময়োপযোগী একসেসরিজ, হৃদয় দোলানো পারফরমেন্স আর সুরের সৌকর্য সবকিছু মিলিয়েই ক্রমশঃ জনপ্রিয়তার শীর্ষে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়া এ ধারা অব্যাহত থাকবে তেমনটিই আশা করা যায়। জয়তু কর্ণিয়া।
আপনার মন্তব্য দিন