মইনুল হক রোজ : চাইলে তাঁকে নিয়ে গল্প লেখা যায়, চাইলে উপন্যাসও লেখা যায়। আবার এমনও হতে পারে তাঁকে নিয়ে দেখা শুরু করলে সেটা শেষ নাও হতে পারে। তিনি মানুষটাই এমন। নিজের কাজ এবং কর্মসূত্রে নিজের কাজকে তিনি এমনই এক অবস্থানে নিয়ে গেছেন যার তুলনা তিনি শুধু নিজেই। তিনি ফারুক, চিত্রনায়ক ফারুক, “মিয়াভাই” ফারুক। পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান দুলু। কিন্তু বাংলা চলচ্চিত্রে তার পরিচয় একটাই – চিত্রনায়ক ফারুক,“মিয়া ভাই” ফারুক।
দেশীয় চলচ্চিত্রের এক অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায় চিত্রনায়ক ফারুকের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট। জন্মের পর মাত্র আট বছর বয়সে তিনি হারিয়েছিলেন মা আফজালুন্নেসাকে। মাকে হারানোর পর বাবা আজগর হোসেন পাঠানও আর বিয়ে করেননি। আর বলা যায় অল্প বয়সে মা-হারা হওয়ার কারণেই কিছুটা দুরুন্ত তিনি হয়ে উঠেছিলেন সেই বয়স থেকেই। তার নিজের ভাষায় যা অনেকটা এরকম, “৫ বোন ও ২ ভাইয়ের মধ্যে আমিই সবার ছোট ছিলাম। মাকে আট বছর বয়সে হারানোর পর স্বাভাবিকভাবেই আদর এবং স্বাধীনতা পেয়েছিলাম বেশি, যে কারণে আমি কিছুটা দুষ্ট হয়ে উঠেছিলাম। আরো পরিষ্কারভাবে যদি বলতে হয় তাহলে বলা চলে ডিরেইলেড হয়ে গিয়েছিলাম।” মিয়া ভাইয়ের ভাষায় “ডিরেইলেড” হয়ে যাবার কারণে সেই সময় থেকে শুরু করে চলচ্চিত্রে নায়ক ফারুক হিসেবে আবির্ভুত হবার আগে পর্যন্ত অনেকেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন “দুলু” নামটির সাথে। এই নামটি তখন অনেকেই ভয়ের চোখে দেখতেন যেমন, তেমনি আবার শ্রদ্ধার সাথেও দেখতেন। এ বিষয়ে শোনা যাক মিয়া ভাইয়ের ভাষ্য,“দুষ্টতো একটু ছিলামই এইটাতো আর অস্বীকার করতে পারি না (হেসে)। তবে এইটাও ঠিক আমার দুষ্টামিতে কারো ক্ষতি হোক সেটা আমি কখনোই চাইতাম না। তারপরও ছোট ছিলামতো কিছু ভুলতো হতেই পারে। তবে যদি আমি আমার ভুল বুঝতে পারতাম তাহলে সেটা ঠিক করারও চেষ্টা করতাম।” এই দুষ্টামির আমলেই তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতেও। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অমোঘ ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কাছে তিনি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সপে দিয়ে নিজেকে জড়িয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সেই সময়ে দেশের সকল আন্দোলনে।
“দুলু” থেকে “চিত্রনায়ক ফারুক” – কিভাবে একটি মানুষের এই বিশাল বদল? প্রশ্নের উত্তর শোনা যাক তাঁর মুখ থেকেই – “আসলে আমারতো কোনো ইচ্ছাই ছিল না এই ব্যাপারে। ১৯৬৭/১৯৬৮ সালের দিকে তখন রাজনীতি নিয়ে আমি ব্যস্ত। সেই সময় আমার নামে প্রায় ৩৭টা মামলা ছিলো। তো এই মামলার ঝামেলা থেকে বাঁচি কেমনে ? তখন আমাকে আমার বন্ধু-বান্ধব অনেকেই বুদ্ধি দিলো – তুই ফিল্মে ঢুইকা যা। তাইলে আর তোরে কেউ কিছু বলবে না। আমিও ভাবলাম আচ্ছা দেখি। এই আচ্ছা দেখি করতে যেয়েই ১৯৬৮ সালে আমি আমার প্রথম ছবি “জলছবি” এর শুটিং শুরু করলাম। যার পরিচালক ছিলেন এইচ আকবর। আর আমার প্রথম ছবিতেই নায়িকা ছিলেন কবরী ম্যাডাম। এই ছবিটি নিয়ে আমার একটা দুঃখের বা কষ্টের জায়গা আছে। আর তা হলো, এই ছবিটি মুক্তি পেয়েছিলো ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। ২৫ মার্চ রাতে এই ছবিটির শো সেসব দর্শক দেখতে গিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই সেদিন রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন। যে কারণে দেশ স্বাধীনের পরেও এই ছবিটি আর প্রদর্শন করা হয়নি আজ পর্যন্ত কোনো হলে। এই বিষয়টা ভাবলে আমি এখনো অনেক কষ্ট পাই।
এরপর ১৯৭৩ সালে শ্রদ্ধেয় খান আতাউর রহমানের পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র “আবার তোরা মানুষ হ”তে আমি অভিনয় করি। খান আতা সাহেব আমাকে তার আপন ছেলের মতো আদর করতেন। তো এই ছবিটির পরপরই ১৯৭৪ সালে অভিনয় করি আরেক গুণী চিত্র পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতার “আলোর মিছিল” এ। এই দুটি চলচ্চিত্রেই আমি পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। এরপর ১৯৭৫ সালে আমি অভিনয় করি চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত “সুজন সখী” ও নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত “লাঠিয়াল” চলচ্চিত্রে। এই দুটি চলচ্চিত্র সেই সময় ব্যাপক ব্যবসা সফল হয়। আমিও নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাই। ওই বছরই আমি “লাঠিয়াল” চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য “সেরা পার্শ্ব অভিনেতা” হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাই। এরপর ১৯৭৬ সালে “সূর্যগ্রহণ” ও “নয়নমনি”, ১৯৭৮ সালে শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত আব্দুল্লাহ আল মামুনের “সারেং বৌ”, আমজাদ হোসেন সাহেবের “গোলাপী এখন ট্রেনে” এবং সর্বশেষ ২০০৬ সালে আজাদী হাসনাত ফিরোজের “ঘরের লক্ষী” সহ প্রায় ২০০ এর মতো ছবিতে অভিনয় করেছি। এই হলো সংক্ষেপে আমার চিত্রনায়ক ফারুক হয়ে উঠার গল্প।”
আর তাহলে প্রেম-ভালোবাসা! এতবড়ো নায়ক,এতো এতো নামকরা-জনপ্রিয় নায়িকাদের সাথে কাজ করেছেন -তার কাছে কি আর এই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন বাদ যেতে পারে? মিয়াভাই-চিত্রনায়ক ফারুকের কাছে সরাসরি প্রশ্ন – “প্রেমতো আপনি নিশ্চয়ই অনেক করেছেন। সে সময়ের অনেক নায়িকার সাথেইতো আপনার প্রেমের গল্প শোনা গেছে তখনো এবং তা নিয়ে কৌতূহল আছে এখনো।” মিষ্টি হেসে চিত্রনায়ক ফারুকের উত্তর,“যেখানে প্রেম নেই, সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া মুশকিল। প্রেম থেকেই পৃথিবীর সৃষ্টি। আবার প্রেমহীনতার জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে। প্রেম চিরন্তন। একজন খুনির পাষাণ বুক খুড়ে দেখলেও এক ফোঁটা প্রেমের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। প্রেমের প্রকাশ নিয়ে প্রতিটি মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য পাওয়া যায়। একেকজনের “দর্শন” একেক রকম। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রক্তের রঙ যেমন একই, প্রেমের ভাষাও একই।
অন্তর থেকে প্রেম বেরিয়ে আসে। সবচেয়ে বড় বিষয় প্রেম ছাড়া অভিনয় করা যায় না। রোমান্টিক দৃশ্যে যদি আমি আমার নায়িকার সাথে রোমান্টিকতাই ফিল না করি সেই দৃশ্য রোমান্টিক হবে কিভাবে? নায়িকারা যদি প্রেম না করে তাহলে বাইরের মেয়েরা প্রেম করবে কীভাবে। একসাথে কাজ করতে করতে সব সেক্টরেই ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায়। ওইটাকে আমি সম্পর্ক বলি। আর ওই সম্পর্ক থেকেই আস্তে আস্তে দোস্তি হয়। যেটাকে অনেকে সুন্দর করে বলে “উই আর ফ্রেন্ডস” (মুচকি হেসে)। দোস্তির পর হয় প্রেম। আমি সবার সাথে কাজ করেছি। আমি চলচ্চিত্রে জুটি প্রথা ভেঙে দিয়েছি। শবনমও আমার নায়িকা ছিল, ববিতাও হয়েছে, শাবানা-কবরী আর রোজিনারাও হিট ছবি পেয়েছে আমার সঙ্গে। আমি সবার সাথেই প্রেম করেছি! আমি অ্যারোগেন্ট প্রেমিক! আমার-ববিতা জুটির প্রেম নিয়েইতো বেশী কথা হয়েছে। কারণ হলো আমাদের জুটি অনেক হিট চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছে। আবার নায়িকা রোজিনার সাথেওতো আমার ৪২টা হিট চলচ্চিত্র রয়েছে। ও কি অপরাধ করলো তাহলে? প্রেমতো তাহলে রোজিনার সাথেও ছিল! এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে সবাই খালি ববিতার কথা বলো কেন? আসলে তখন অনেকেই গসিপ লিখতেন, ফারুক-ববিতা খুব প্রেম করছে। ওই লেখা প্রেম এখনও চলছে, চলবে। আসলে প্রেম এতো সহজ নয়। এটা আপনা থেকেই আসে। “চিত্রনায়ক ফারুকের এই ভাষ্যমতেই প্রেম তার জীবনেও আপনা থেকেই এসেছিলো। যা কিনা এখন তার জীবনসঙ্গিনী। চিত্র নায়ক ফারুক-ব্যক্তি ফারুকের সেই প্রেমের নাম ফারজানা পাঠান। এই প্রেমিক দম্পত্তির দাম্পত্য জীবনে ফারিহা তাবাসসুম নামের একটি কন্যা ও রওশন হোসেন নামের একটি পুত্র সন্তান রয়েছে।
২০০৬ সালে সর্বশেষ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পর সরাসরি চলচ্চিত্র জগতে থেকে কিছুটা দূরে থাকলেও দেশীয় চলচ্চিত্রের একটি ক্রান্তিকালে যখন গঠন করা হয় “চলচ্চিত্র পরিবার” তখন সবার ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি এই পরিবারের আহবায়কের গুরু দায়িত্বটি গ্রহণ করেছেন নিজের শত ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ব্যস্ততার মাঝেও। দেশীয় চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে মিয়াভাই বললেন, “আসলে খারাপ সময়তো সব ইন্ডাষ্ট্রিতেই আসে, আবার সময়ের সাথে সাথে তা বদলেও যায়। তাই আমাদের বর্তমান অবস্থার উন্নতি কবে ঘটবে তার সময়ক্ষণ নিয়ে কথা বলা মুশকিল। তবে চলচ্চিত্রে আবারও ধীরে ধীরে ভালো দিন আসছে। হলে লোকজন যাচ্ছে। আমরা অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সামগ্রিকভাবে সরকার চায় চলচ্চিত্রের উন্নতি হোক। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু উদাসীনতা আছে। সেইসব উদাসীনতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে চলচ্চিত্রের দিন বদলটা হবে অসম্ভব। তবে একইসাথে আশার কথা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেল বছর থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি আন্তরিক হয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ইন্ডাস্ট্রির জন্য কিছু করতে চান। এরইমধ্যে ৫০টি সিনেমা হল আধুনিকায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে হলে ই-টিকিটিং ব্যবস্থাও চালু হবে বলে তথ্য মন্ত্রণালয় কথা দিয়েছে। এগুলো আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নে এগিয়ে নেবে। এখন আমাদের হলগুলোর পরিবেশ বদলানো দরকার। চলচ্চিত্রের গল্পও বদলানো দরকার। শুনেছি এবারের ঈদে কিছু ভালো ছবি আছে। আর তাই আর সবার মতো আমিও সবাই আশা করছি দর্শকরা হলে যাবেন, ছবি দেখবেন আগের মতো নিয়মিত। “সম্প্রতি হাইকোর্ট রায় দিয়েছে কোনো উৎসবের সময় বিদেশি ছবি আমদানি করা যাবে না। তবে যৌথ প্রযোজনার ছবি চলতে পারে। এই বিষয়টিকে ইতিবাচক বলেই মনে করছেন মিয়া ভাই। আর যৌথ প্রযোজনার সঠিক নিয়ম মেনে যদি ছবি নির্মিত হয় তবে ঈদে বা পূজায় মুক্তি পেতে দোষ নেই। যৌথ প্রযোজনার ছবিতে নিজ দেশেরওতো অংশগ্রহণ থাকে।”
চলতি বছরে মনোনীত হয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সর্বোচ্চ পুরস্কার আজীবন সম্মাননা বিভাগে। তবে তার সাথে এই আজীবন সম্মাননা পুরস্কারটি যৌথভাবে পাচ্ছেন দেশীয় চলচ্চিত্রের আরেক কিংবদন্তী চিত্রনায়িকা ববিতাও। ক্যারিয়ারের এই সময়ে এসেও এই ভাগ করে আজীবন সম্মাননা দেয়া নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ রয়েছে মিয়া ভাই এর। এ বিষয়ে তার বক্তব্য, “আজীবন সম্মাননা কখনোই ভাগ করা উচিত নয়। এর আগেও আজীবন সম্মাননা ভাগ করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। আমি তখনো প্রতিবাদ করেছিলাম। এটা ঠিক নয়। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে দুজনেক যৌথভাবে পুরস্কার দেয়া আর দুজনকে আজীবন সম্মাননা দেয়া আলাদা বিষয়। পৃথিবীর কোথাও দুজনকে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয় না। আমরা কেন এই সংস্কৃতি চালু করেছি? আমি মনে করি যেদিন প্রধানমন্ত্রী কাউকে এই সম্মাননা দেবেন সেদিন সেই মানুষটা হবেন একজন রাজার মতো। তার আনন্দ হবে রাজ্য জয়ের। তিনি হবেন অন্য সবার চেয়ে আলাদা, অধিক সম্মানের। সেখানে ভাগ কেন হবে? ববিতারওতো এই চলচ্চিত্র শিল্পে অবদান রয়েছে। একজন নারী হিসেবে হাজার প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গে রয়েছেন প্রায় পাঁচ দশক। তারওতো এই পুরস্কার এককভাবে পেলে নিশ্চয় আরো বেশি ভালো লাগতো। “তবে নিজের এই ক্ষোভের পরেও সরকারের এই সিদ্বান্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করবেন চিত্রনায়ক ফারুক। নিজের ক্ষোভ-দুঃখ আড়ালে লুকিয়ে সারাজীবন মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে আসা এই কিংবদন্তী শিল্পীর “মিয়া ভাই” নামের স্বার্থকতা এখানেই। “মিয়া ভাই” বলেই তিনি এখনো ভাবেন তার কোন কথা বা কাজে যদি দেশীয় চলচ্চিত্রের উন্নতি হয় , ভালো হয় তিনি তা করবেন নিজে কষ্ট পেলেও। আর এই কারণেই বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে “মিয়া ভাই” একজনই এসেছেন, একজনই থাকবেন। তিনি চিত্রনায়ক ফারুক – আমাদের “মিয়া ভাই”।
আপনার মন্তব্য দিন