আবদুল জাববার খান : হঠাৎ করেই ছুটির ঘোষণা।মার্চ ২৬ থেকে এই ছুটির শুরু। বাধ্যতামূলক ছুটি। দেশে ভয়াবহ ভাইরাস কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। তাই সব বন্ধ থাকবে। দুদিন আগে থেকেই অফিসে এটা নিয়ে কানাঘুষা চলছে। কার কী প্ল্যান, কোথায় কাটাবে এই হঠাৎ পাওয়া ছুটি, এসব নানারকম চিন্তা ভাবনা নিয়ে। কেউ কেউ আগেই ছুটি নিয়ে গ্রামে চলে গেছে। সবার মাথা গরম। সারাদেশেই এই অবস্থা। অফিসিয়াল রেস্ট্রিকশন অলরেডি লুজ।
আমার বাসার পরিস্থিতিও এটা নিয়ে গরম। সুমি ( আমার স্ত্রী ) কিছুতেই ঢাকায় থাকবে না। ময়মনসিংহের ভালুকায় আমাদের বসুধা রিসোর্টে চলে যাবে। অনেক দিন যাওয়া হয় না। তার নিজের হাতে লাগানো ফুল ফলের চারাগুলো এখন কতোটুকু বড় হয়েছে, দেখা দরকার। ফোনে কথা বলা আর সরেজমিনে দেখা যে এক কথা নয়, এটা শুনতে শুনতে আমার কাহিল অবস্থা।
আমি একেবারেই রাজি নই।
আমার মাথায় চিন্তা, অফিসের লোকজনকে বিদায় দিতে হবে। নতুন বেশ কিছু বিজনেস প্ল্যান নিয়ে কাজ করছি। এ অবস্থায় কোনভাবেই আমি ঢাকা ছাড়বো না।
২৫ তারিখ সকালে সুমির হাতে কিছু টাকা দিয়ে বললাম,
: একটা কাজ করতে হবে। আমরাতো লক ডাউনের প্রস্তুতি নেয়ার সামর্থ্য রাখি। যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের কথা ভেবে মনটা ভীষণ খারাপ। কাজ না করলে এরা খাবে কী ? শুনেছি, ঢাকা শহরের দোর্দন্ড প্রতাপশালী রিকশাওয়ালারা নাকি হঠাৎ করে প্যাসেন্জার কমে যাওয়ায় কঠিন সংকটে পড়েছে। এখন নাকি, যেকোন ভাড়ায়, হাতে পায়ে ধরে প্যাসেন্জার নিচ্ছে। খুব খারাপ লাগছে ওদের জন্য। বড় মেয়ে ওয়ামিয়াকে নিয়ে দুর্বল এবং অসহায় কিছু রিকশাওয়ালাকে গোপনে এই টাকাগুলো দান করে দাও। সুমি ভীষণ খুশি। কারণ, দান খয়রাতে বরাবরই সে সিদ্ধহস্ত। কলা কিনলেও সবচাইতে বৃদ্ধ লোকটার কাছ থেকেই কিনবে। পাকা, কাঁচা, পঁচা, কিছুতেই কিছু যায় আসে না। কোন দামাদামি করে না।
পরে, আমি অফিসে বসেই ফোনে তাদের এই মিশনের সফলতার কথা শুনেছি। বিকেলে বাসায় এসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম,
: গরীবদের কে নিজের হাতে দান করতে কেমন লাগলো মামনি?
ওয়ামিয়া উত্তেজনায় টগবগ করছিলো। বললো,
: বাব্বা, অসাধারণ একটা এক্সপেরিয়েন্স হলো। বৃদ্ধ এবং দুর্বল রিকশাওয়ালাদেরকে আমরা গাড়িতে বসেই সিলেক্ট করেছি। তারপর গাড়ি থামিয়ে নেমে, ডেকে টাকাটা হাতে গুঁজে দিয়েছি। বলেছি, এটা দিয়ে ৮/১০ দিনের বাজার করে বাসায় ফিরবেন। কেউ কেউ খুশিতে কেঁদে ফেলেছে। অনেক অনেক দোয়া করেছে ওরা। আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে টাকা সেইভ করে মাঝে মাঝে এই কাজটা করবো।
আমি বললাম,
: আলহামদুলিল্লাহ!
আসলে, আমার উদ্দেশ্য সফল হবার আনন্দে আমি ছিলাম বিভোর। মনে মনে দোয়া করেছি, আল্লাহ্ তায়ালা যেন তাদেরকে এভাবেই দানশীল হবার তৌফিক দান করেন।
এই এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করার সময় ওদের চোখ ছলছল করছিলো। আমার চোখও মনে হয়, কিছুটা ঝাপসা হয়ে গেল।
মেয়েরা সবসময় মায়ের পক্ষ নেয়। আমাকে চমকে দিয়ে ওরা এবার আমার পক্ষ নিলো। আমি আমার মেয়েদেরকে চিনি। ক্রেন দিয়ে টেনেও ওদেরকে মা’র বিপক্ষে নেয়া সম্ভব নয়।
তাহলে, অবশ্যই ভিন্ন কোন মতলব আছে। ধরতে সময় লাগেনি। ঢাকায় থাকলে, সারাক্ষণ ওয়াইফাই এর আওতায় থাকবে। সুযোগ পেলে আশেপাশের রেস্টুরেন্টে ফ্রেন্ডসার্কেল নিয়ে আড্ডা। সব সৌখিন চিন্তা ভাবনা। তাই ওদের ধারণা, বাবার সিদ্ধান্তই সঠিক।
ভালুকায় যাওয়ার দরকার নেই।
তখনও করোনার ভয়াবহতার ব্যাপারটা এরকম সিরিয়াসলি নেয়নি কেউ।
এসব নিয়ে মা মেয়েদের মধ্যে মোটামুটি দুই এক পশলা ঝগড়াঝাঁটিও হয়ে গেল।
এই প্রথমবারের মতো সুমি বেচারি একা হয়ে ভীষণ মন খারাপ। আমার কিন্তু খুশি হবার কথা। কিন্তু ওর বিষন্নতা দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে গেল। এরিমধ্যে প্যারিস থেকে বন্ধু চন্দন ফোনে কথা বললো।
সব শোনে তার বক্তব্য,
: দোস্ত, কোন কথা নয়। সোজা সবাইকে নিয়ে বসুধা রিসোর্টে চলে যাও। ওখানে নিরাপদে থাকবে। কল্পনাও করতে পারবে না যে আমরা এখানে কি বিপদে আছি। প্রতিদিন অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। সবকিছুই বন্ধ। আমরা দুই মাসের বাজার একসাথে করে বাসায় ঢুকে গেছি। দরোজাটা পর্যন্ত খুলি না।
বেঁচে থাকলে আবার কাজকর্ম করা যাবে।
আমি ওর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। অসন্তোষ চেপে রেখে বললাম,
: ঠিক আছে দোস্ত। চাচ্ছিলাম না। কিন্তু তুমি যেহেতু বলছো, আমি সবাইকে নিয়ে চলে যাচ্ছি ভালুকায়।
বন্ধু চন্দন খুশি। সুমিও খুশি। এবার কন্যাদেরকে আমিই কনভিন্স করলাম। পিচ্চি জাহিনের এখনও পাঁচ বছর পুরো হয়নি। তাই ওকে নিয়ে ঝামেলা নেই।
বাসায় সুমিকে সাহায্য করার জন্য দুজন মেয়ে আছে। আমার কিছু লোকজন আছে। সাথে যোগ দিলো ছোট ভাই শিপন, তার বউ এবং একমাত্র ছেলে।
সবাইকে নিয়ে ২৫ তারিখ রাতের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ভালুকায়, আমাদের বসুধা রিসোর্টে।
ওখানে সুমির ডিরেকশনে আগে থেকেই রান্নার আয়োজন করা ছিল। তাই ডিনার নিয়ে কোন টেনশন নেই। রিসোর্টের স্টাফদের কে ডেকে মেইন গেট এ তালা লাগাতে বললাম। ওদের বলে দিলাম,
: সরকারি আদেশে কোয়ারেন্টাইন পালন করার জন্য এসেছি। বেড়াতে আসিনি। পিকনিক করতেও নয়। আমার আদেশ ছাড়া এই গেট খুলবে না। নো এন্ট্রি। নো এক্সিট। সবাই বিনা বাক্য ব্যয়ে এই কথাটা মেনে নিলো।
দুদিন পর, বিকেলের দিকে, ডাইনিং রুমের বারান্দায় বসে ফেসবুক ঘাটছিলাম। সুমি এসে পাশের চেয়ারে বসলো জিজ্ঞেস করলো, কী অবস্থা ঢাকায়?
তার প্রশ্নটা করার কারণ হচ্ছে, এখানে আসার পর থেকে গাছপালা, রান্নাবান্নার আয়োজন, অনলাইনে বাচ্চাদের পড়াশোনা, এসব নিয়ে খুব ব্যস্ত সে। বাচ্চারাও রিসোর্টের নানা জায়গায়, ডুপ্লেক্সের ছাদে বসে সময় কাটায়। বোরড হতেও সময় লাগবে। ওরা কেউই ফেসবুক দেখার সময় পায় না।
আমি খুব মন খারাপ করে বললাম,
: করোনায় মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। নানা এলাকা টোটালি লক ডাউন করে দিচ্ছে প্রশাসন। মানুষ ভয়ে, আতংকে অস্থির হয়ে উঠেছে। ভাগ্য ভালো যে আমরা সময়মতো এখানে শিফট করেছি।
সুমি স্থির দৃষ্টিতে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর বললো,
: তখনতো আসতেই চাওনি। এখন বলছো, ভালো হয়েছে এসে। কী ভেবে নেবো আমি ?
ওর প্রশ্নটা শুনে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ওর হাত দুটো চেপে ধরে বসে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। তারপর গভীর অনুতাপ নিয়ে বললাম,
: আই এম রিয়েলি স্যরি। তোমার কথা না শুনলে হয়তো বিপদেই পড়ে যেতাম। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়েরা যখন তখন লকডাউন ভেঙ্গে বাইরে যেতে চাইতো। বাংলায় পড়া বাবার কথায় পাত্তাই দিতো না। সবাই বিপদে পড়তাম। এখানে তো অফিসিয়াল অর্ডারে গেট বন্ধ।
ওরা হাজার বললেও কেউ গেট খুলে দেবে না। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি।
আমি খেয়াল করলাম, সুমির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
ব্যবসায়িক ব্যস্ততার কারণে আমার বাচ্চারা আমাকে এভাবে কখনোই কাছে পায়নি। তাই ওদের সাথে বিশাল একটা গ্যাপ ছিল। এখন আমরা বিকেলের দিকে সবাই মিলে হাঁটাহাঁটি করি। রুটিন এক্সারসাইজ। ফ্যামিলির সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দেই। ক্যারম খেলি। সুইমিং পুলে ঝাঁপাঝাঁপি করি। মেয়েরা সন্ধ্যার পর প্রায় প্রতিদিনই লুডু নিয়ে বসে। কখনো মাকে নিয়ে রান্নাবান্না শেখায় ব্যস্ত হয়ে যায়।
এখন অবশ্য রমজানের প্রস্তুতি চলছে। সস্তায় এবং সহজে কী কী রান্না করা যাবে, তা নিয়ে গবেষণা করছে সবাই। কারণ, রসদপত্র সীমিত। খরচ কিছুতেই বাড়ানো যাবে না। আমিও একটু আইডিয়া দিতে চাইলাম। দূর দূর করে খেদিয়ে দিলো। বললো যে এটা নাকি ইট, কাঠ, রড, সিমেন্টের ব্যাপার না।
আমি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কারও কোন মাথাব্যথা বা আপত্তি নেই। মোট কথা, একসঙ্গে থাকার ব্যাপারটায় সবাই মজা পেয়ে গেছি। সকাল হলেই অফিসের টেনশন নেই। বাচ্চাদের স্কুলের ঝামেলা নেই। ছোট মেয়ে অরিন ‘ও লেভেল’ এর ফর্ম ফিল আপ করে এসেছে। সেটাও বাতিল হয়েছে। কারও কোন টেনশন নেই। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা। টেনশন ছাড়াও যে জীবন যাপন করা যায়, এটা এই জীবনে প্রথম জানলাম। এসব দেখি, অনুভব করি, আর মুগ্ধ হতে থাকি।
দীর্ঘ ২৫ বছরের বিবাহিত জীবনে, নিজেদের সম্পর্কের মধ্যে অনেক খাদ জমে গিয়েছিলো। একসঙ্গে থাকার কারণে সেই খাদগুলো প্রতিদিনই অপসারিত হচ্ছে। স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যকার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা ফিরে পাচ্ছি।এভাবে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে না থাকলে অপসারণ দূরে থাকুক, বুঝতাম কিনা, সেটাও চিন্তার বিষয়।
এই লেখাটির পাঠকদের জন্য আমি বলতে চাই –
: দুঃসময় দীর্ঘস্থায়ী কোন ব্যাপার নয়। সরকার আমাদের নিরাপত্তার জন্যই লক ডাউনের ব্যবস্থা করেছে। এই সময়টাতে ঘরে থেকেই আমরা সরকারকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারি। সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবেশীর জন্য কিছু করতে পারি। যারা এটা বোঝে না, তাদেরকে বোঝাতে পারি।
অনিয়ম সবসময়ই ছিল, এখনও আছে। তারপরও সরকার তার সাধ্যমতো পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট।
আমরা ঘরে থাকি। ফ্যামিলিকে সময় দেই। নতুন এক ভালোবাসাপূর্ণ জগত গড়ে তুলি।
হ্যাপি কোয়ারেন্টাইন!!!
লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বসুধা বিল্ডার্স লিঃ
আপনার মন্তব্য দিন