শপথ চৌধুরী : দেশীয় চলচ্চিত্রে প্রতিনিয়তই সংযোজন হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। কিন্তু টিকে থাকার সংখ্যা খুবই নগন্য। কারণ চলচ্চিত্র এমন একটি জায়গা যেখানে টিকে থাকতে হয় অত্যন্ত সংগ্রাম করে। তৈরি করে নিতে হয় নিজের অবস্থান। বিপাশা কবির তেমনই একজন। সংগ্রাম করে তিলে তিলে তৈরি করে নিচ্ছেন নিজের অবস্থান। সাম্প্রতিক সময়ে রাইজিং স্টারদের মধ্যে তাকে অন্যতম বলা যায়। তবে তার সমসাময়িক অন্য যে দু’একজন নায়িকা আলোচনায় আছেন তাদের সঙ্গে বিপাশার একটু অন্যরকম পার্থক্য রয়েছে। কারণ অন্যরা শুরুতেই নায়িকা ইমেজ নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। আর বিপাশা প্রতিষ্ঠিত অন্য আরেকটি ইমেজ থেকে পরিপূর্ণ নায়িকা হিসেবে নিজের ইমেজ তৈরির চেষ্টায় সংগ্রাম করে চলেছেন।
মূলতঃ আইটেম গার্ল হিসেবে দেশীয় চলচ্চিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং চাহিদাসম্পন্ন মুখ বিপাশা করিব। মনের দিক থেকে উদার বলেই নায়িকা হওয়ার সব রকম যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনুরোধ রাখতে রূপালী জগতে পা ফেলেছিলেন একজন আইটেম গার্ল হিসেবে। অথচ গ্ল্যামার মিডিয়ায় তার অভিষেক হয়েছিল বড় একটি প্লাটফর্মে পা রেখেই।
২০০৯ সালের কথা। বিপাশা তখন ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক এ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম সেমিস্টারের স্টুডেন্ট। সুন্দরী হলে যা হয়। বন্ধুরাই উৎসাহ যোগায় মিডিয়ায় কাজ করার ব্যাপারে। কিন্তু কিভাবে কাজ করবেন সেরকম কোন সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অবশেষে বন্ধুদের উৎসাহে অংশগ্রহণ করেন লাক্স-চ্যানেল আই সুন্দরী প্রতিযোগিতায়। সাফল্য পেলেন। টপ ফরটিন এ নিজের জায়গা করে নিলেন। কিন্তু খুশী হতে পারলেন না তিনি। কিন্তু কেন? এ প্রসঙ্গে বিপাশা জানান, আমার টার্গেট ছিল মিনিমাম টপ টেন-এ থাকবো। যথেষ্ট কনফিডেন্টও ছিলাম। কিন্তু অজানা কারণে পিছিয়ে পড়লাম। তবে সোজাসাপ্টা বলে দিলাম, লাক্স-চ্যানেল আই’র এই প্রতিযোগিতায় আরো অনেক দূর যাওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল। আমি হারিনি বরং তারাই আমাকে হারিয়েছে। কারণ যাকে পাশে রেখে আমাকে আউট করা হয়েছিল আমি কনফিডেন্ট তার বা আরো অনেকের চেয়ে আমি অনেক বেশি যোগ্য ছিলাম। বর্তমান পরিস্থিতিতে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যারা ২০০৯-এ টপ টেনও ছিলো তাদের অনেকেই হারিয়ে গেছে কিন্তু আমি ঠিকই নিজের যোগ্যতায় কাজ করে যাচ্ছি। যাই হোক, প্রতিযোগিতায় থাকাকালী ওখানে যে গ্রূমিং করেছিলাম সেটা আমার যথেষ্ট কাজে লেগেছে। পাশাপাশি চ্যানেল আইও আমাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
বিপাশা কবির আসলে এমনই। খুব আউটস্পোকেন। সুন্দরী নায়িকা, তার থেকেও সুন্দর তার হাসি। এই মায়াবী হাসিতেই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছে বড় পর্দার দর্শকরা। সৃষ্টি হয়েছে তার নিজস্ব ভক্তশ্রেণী, দর্শক। আটপৌরে চেহারা, কিন্তু তাতে অন্যরকম রোশনাই আছে। বঙ্কিম কটাক্ষ, লাস্যময় ভঙ্গি ইত্যাদি কোন ছকবাঁধা বিশেষণে বাঁধা যায়না উজ্জল, স্বতঃস্ফূর্ত বিপাশা কবিরকে। সুখ-দুঃখের নানা ফুলের মালা গেঁথে চলচ্চিত্র ক্যারিয়োরের অর্ধযুগ অতিক্রম করলেও আশা-নিরাশায় উদ্বেল নন তিনি। বরং নিজের অবস্থান নিয়ে বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই তার। তবে স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট তিনি। অবস্থানের বিষয়েও তার কোন অভিযোগ নেই। বিপাশা বলেন, ‘আমার যোগ্যতা নিয়ে আমি পুরোমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী। প্রয়োজন শুধু নিজেকে এক্সপোজ করার জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র। নায়িকা হিসেবে আমি ইতিমধ্যে ৭টি ছবিতে কাজ করেছি। নিঃসন্দেহে এ ছবিগুলো আমার ক্যারিয়ারে অনেক কিছুৃ যোগ করেছে। কিন্তু ভালোভাবে ক্লিক করার জন্য আমার আরো ভালো কোন সুযোগ প্রয়োজন।’
আপনার ক্যারিয়ারে মূল প্রতিবন্ধকতা কি বলে মনে করছেন?
আমার শুরুটাই আসলে ভুল দিয়ে। ২০১২ সালে জাজ-এর ছবি ‘ভালোবাসার রঙ’ এ আমি প্রথম অভিনয় করি। সেখানে আইটেম সঙ এ পারফর্ম করে আলোচনায় আসি। আমার পরিচিতি গড়ে ওঠে একজন আইটেম গার্ল হিসেবে। দিন যতোই গড়িয়েছে চাহিদা ততোই ঊর্ধ্বমুখী ছিল। বিপাশা কবিরকে আইটেম গার্ল ইমেজেই সবাই চিনেছে। আর এটাই হয়েছে আমার কাল। আইটেম সঙ এ পারফর্ম করার বিষয়টি আমি যতোটা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট বেশীর ভাগ মানুষই ঠিক ততোটাই নেগেটিভ ভাবে চিন্তা করেছে। যে কারণে আমি যখন নায়িকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছি, ভিলেইন হিসেবে সামনে চলে আসছে আইটেম গার্ল’র ইমেজ। এই ইমেজ ভাঙা আমার জন্য খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে ৭টি ছবিতে নায়িকার রোলে অভিনয় করলেও ইমেজ ভাঙার বিষয়টি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। অথচ একসময় যারা আমাকে অনুরোধ করে তাদের ছবিতে আইটেম সঙ এ পারফর্ম করিয়েছে তারাই এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। অনেক নায়কও আমাকে নায়িকা হিসেবে মেনে নিতে ইতস্তত করছে। এসব কারণে অনেক সময় কষ্ট পাই। কিন্তু তাই বলে হতাশ হইনা। কারণ আমি জানি, সুযোগ পেলে আমি অনেক কিছুই ভেঙ্গেচুরে দিতে পারবো। যত বাধাই আসুক, আমি লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো। ইনশাআল্লাহ।
অনেকেই বলে থাকেন চলচ্চিত্রে নায়িকা সঙ্কট চলছে। আপনার কি মনে হয়?
আমি সেটা মনে করি না। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন মুখ আসছে। এদের মধ্যে সবাই কি যোগ্যতাহীন। বরং আমি বলবো, নতুনদের ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারছেনা কেউ। সুযোগ না পেলে কেউতো নিজের ভিতরের যে আগুন তা প্রকাশ করতে পারবে না। আসলে যারা এখন চলচ্চিত্রে কাজ করছে অনেকের মধ্যেই সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু তাদের সঠিকভাবে ইউটিলাইজ করা হচ্ছে না। আমি মনে করি, পরিচালকরা হলেন আমাদের কাছে গুরুর মতো। তারা যদি আমাদের বেষ্ট অ্যাফোর্টটা বের করে নিতে না পারেন, তাহলো তো নায়িকা সঙ্কট তৈরি হবেই। বরং সত্যি বলতে নায়িকা সঙ্কট নয়; ভালো গল্পের ছবি, ভালো প্রযোজকের সঙ্কট রয়েছে। ভালো পরিচালক রয়েছেন, তবে তারাও ঠিকমত সুযোগ পাচ্ছেন না। ইদানীং আবার অনেক নায়িকাই প্রযোজক নিয়ে আসছেন। যে কারণে পরিচালককে ওই নায়িকার প্রতি দুর্বল থাকতে হয়। যোগ্যতা না থাকলেও তাকে দিয়ে ছবি বানাতে হয়। এভাবে ছবি তৈরি হলে তো কোন প্রযোজকই তার লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত পাবে না। তাই প্রকৃত যোগ্যদের সুযোগ দিতে হবে। প্রযোজক এনে অযোগ্যরা যদি প্রতিষ্ঠা পেতে চায়, তাহলে সেটা কি সম্ভব?
নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার সবরকম যোগ্যতাই বিপাশার মধ্যে রয়েছে। চমৎকার ফিজিক তার। আলাদা স্পার্ক রয়েছে চেহারায়।ধ্রুপদি মুখ, তাকে দেখলে কোন যুবকের মধ্যেই রিরংসা জাগবে না, বরং জাগবে রোমান্টিকতা। তার কথা বলার স্টাইল, একসেসরিজ সব কিছুর মধ্যেই আলাদা একটা বিষয় রয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে একটা অপ্রতিরোধ্য আবেদন রয়েছে বিপাশার মধ্যে।
চলচ্চিত্রে আসার আগে বিপাশা কবির ছোট পর্দায় বেশ কিছু কাজ করেছেন। বিজ্ঞাপন করেছেন প্যানাভিশন টিভি, প্যানাভিশন ফ্রিজ, নোভা ফ্রিজ এবং মডেল নোবেল ও ইমরানের সঙ্গে আরসি কোলা। অনেক বিলবোর্ডের মডেলও হয়েছেন তিনি। প্রাইড শাড়ীর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন বছর খানেক। অনেক নাটকেও তিনি কাজ করেছেন। বড় পর্দায় আসার পর ছোট পর্দায় আর কাজ করেননি। বড় পর্দাতেই তিনি কাজ করতে চান, তাই ছোট পর্দা নিয়ে আপাতত কিছু ভাবছেন না।
এ পর্যন্ত ৫০টির বেশি ছবিতে আইটেম গার্ল হিসেবে কাজ করেছেন বিপাশা। ২০১৬ সালে প্রথম নায়িকা হন ‘গুন্ডামি’ ছবিতে। তার অভিনীত সর্বশেষ ছবি ছিল ‘পাষাণ’। নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য রীতিমত সংগ্রাম করে চলেছেন। তার ভাষায়, কারো হাত ধরে আমি চলচ্চিত্রে আসিনি। নিজের যোগ্যতাতেই এতদূর এসেছি। বিপাশাকে দেখলে মনে হয় অফুরান প্রাণশক্তি ঠিকরে বের হচ্ছে তার চোখমুখ দিয়ে। সে হিসেবে বলা যায়, বিপাশার সংগ্রাম বৃথা যাবে না। দীর্ঘদিন ধরে দেশীয় চলচ্চিত্রে ইমেজ ভাঙা সম্ভব নয় বলে যে বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে তা ভেঙ্গে দিতে পারবেন বিপাশা কবিরের মতো যোগ্য মেয়েরা। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে বিপাশার পাশাপাশি যেসব নায়িকা রয়েছেন তাদের চাইতে বিপাশা কোন অংশেই কম নন, বরং কিছুটা এগিয়ে আছেন বলা যায়। সে জন্যই আইটেম গার্ল থেকে ইমেজ ভেঙ্গে এক-দুটি নয় সাতটি ছবিতে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষী রেখেছেন। জয়ী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ার পালা। প্রয়োজন শুধু ভালো সুযোগের। জয়তু বিপাশা।
আপনার মন্তব্য দিন