শুভ্রা নীলাঞ্জনা : আমরা তখন ময়মনসিংহ থাকি। বাবা চাকরী সুত্রে খুলনা বদলী হয়েছেন। মা সহ আমারা তিনভাইবোন পড়াশুনার জন্য বাবার আগের কর্মস্থলেই থেকে গেলাম। তখন সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক ওমেন, নাইট রাইডার, ডালাস ইত্যাদি ইংরেজী টিভি সিরিয়ালের যুগ। প্রতিদিন না দেখলে পেটের ভাত হজম হয় না। তখন একটাই চ্যানেল, বি,টি,ভি – বাংলাদেশ টেলিভিশন। তীর্থের কাকের মত টিভির সামনে আমাদের বসে থাকা।
বাবা ছুটি নিয়ে আসছেন, আমাদের সাথে কয়েকদিন কাটাবেন। কয়েকদিন থাকার পর বাবা আবিস্কার করলেন বাবার অবর্তমানে মাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমরা যারপরনাই চারকোনা বাক্সটার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছি। পড়ালেখা রেখে আমাদের আগ্রহটা বেশী চারকোনা বাক্সটার প্রতি। বাবা না থাকলে সেইসময় কেমন যেন একটা অলিখিত স্বাধীনতা আমাদের ভিতর চলে আসত। বাবা না থাকলে আমরা মহাখুশি হতাম। আবার যখনি শুনতাম বাবা আসবেন আমাদের ঝলমলে মুখ নিমেষেই কালো হয়ে যেত।
সেইসময় সচ্ছল পরিবারে টিভির একটা বাক্স ছিল। আমরা তুলনামুলক ভাবে একটু গরীব ছিলাম, তাই আমাদের টিভিটা একটা টেবিলের উপর ছিল। আমরা যে গরীব ছিলাম সেই দুঃখ ঢাকার জন্য আমাদের বাবা মা মন বড় করার সবসময় মন্ত্র দিতেন। ভাবটা এইরকম মন বড় করতে তো আর অর্থ লাগে না। তাই বিনামুল্যের সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইতাম না আমরা।
কিন্তু আমরা যে গরীব ছিলাম তাতে কোন দুঃখ ছিল না। ডিম অর্ধেক করে খেতাম! এক সময় ভাবতাম ডিম মনে হয় অর্ধেকই খেতে হয়! কেউ বেড়াতে আসলে পোলাও খেতাম। পোলাও যে ইচ্ছে করলে খাওয়া যায় – এমন ভাবনা মাথায়ও ছিল না! কিন্তু কেউ আমাদের বাসা থেকে না খেয়ে যেতে পারবে না। কারণ, অতিথি নারায়ন – এইটা আমার মায়ের বিশ্বাস!
বাবার ছুটি শেষ। আবার তার খুলনা যাওয়ার পালা। আমাদের তিন ভাইবোনকে ডেকে যাওয়ার আগে পড়ালেখার তাৎপর্য তুলে ধরে বিদায়ী ভাষণ দিলেন। আমরা মনযোগের ভাব দেখিয়ে অমনোযোগী হয়ে শুনলাম। বাবা এইবার টিভি অরক্ষিত রাখা সমুচিন মনে করলেন না। তিনি যাওয়ার আগে টিভির কাগজের বাক্সের ভিতর ঢুকিয়ে মোটা দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধলেন। ছোটভাইর এস, এস, সি পরীক্ষা সামনে। বললেন পরীক্ষার পর এই বাঁধন আলগা হবে। আমরা মুখ ঝুলিয়ে বাবাকে অপ্রিয় কাজে সাহায্য করি। বাবা নির্দিষ্ট দিনে ৮ টায় চলে গেলেন খুলনার উদ্দেশ্যে রেল স্টেশনে । বাবা মনে হয় স্টেশনে যেয়ে পৌঁছান নাই। আমদের কাঁচি খুঁজার ও সময় নাই বাসার বটি দা দিয়ে ঘচ ঘচ করে দড়ি গুলি কেটে মনের আনন্দে সিক্স মিলিয়ন ডলারম্যান দেখতে বসে পড়ছি।
মনে হয় নয় টায় শুরু হতো। বাবা বাসায় ঢুকতে কখনো কলিং বেল বাজাতেন না। হঠাৎ বাবার কড়া নাড়ার মত শব্দ শুনে আমরা আতংকে এইঘর থেকে ওই ঘরে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছি। মা এসে খবর দিলেন তোর বাবা ট্রেন ফেল করে চলে আসছে। এই খবর শুনার চাইতে তারচেয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লেও অবাক হতাম না। তখন আমাদের অবস্থাটা কী হতে পারে – হাত, পা ভয়ে নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা তিন জনে মিলে কোনভাবেই এতো কম সময়ে টিভিটাকে বেঁধে যথাস্থানে রাখতে না পারায় কট বাই বাবা।
তারপরের ঘটনা অনুমেয়। তবে এইটা বলতে পারি আমার দরিদ্র বাবা একটা টিভির বক্স বানিয়ে চাবিটা পরের বার সঙ্গে করে নিয়ে আমাদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে খুলনা চলে গেলেন।
এই করোনাকালে ছোটবেলার সেই কথাগুলো খুবই মনে পড়ে। কতই না ভালো ছিল আমাদের সেই দিনগুলো। হারানো সেই মধুর অতীত এখনও খুঁজে বেড়াই। সাদাকালো টেলিভিশন দেখা আর অর্ধেক ডিম দিয়ে খাওয়ার সেই আনন্দ এখন আর বুঝি ৬৫ ইঞ্চি রঙীন এলইডি টেলিভিশন আর মস্ত বড় আস্ত ডিমেও পাবো না।
লেখক : বাংলাদেশী কবি ও সাহিত্যিক
আপনার মন্তব্য দিন